পবিত্র বাইবেলে প্রবক্তাগণ (নবি বা ভাববাদী) অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ঈশ্বর তাঁদেরকে আহ্বান করেছেন তাঁর কথা তাঁরই আপন জাতির কাছে পৌঁছে দিতে, তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে। খ্রিষ্টবিশ্বাসী হিসাবে আমরা প্রত্যেকেই সেই প্রবক্তার ভূমিকা পালন করার আহ্বান পেয়েছি। এ কারণে আমাদের ভালোরূপে প্ৰবক্তা কে, প্রবক্তার বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী, প্রবক্তারা কী ভূমিকা পালন করেন এসব বিষয়ে জানা দরকার। এগুলো জেনে আমরা বর্তমান যুগের এক একজন প্রবক্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করব।
প্রবক্তা সম্পর্কে সর্বপ্রথমেই আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যে ব্যক্তি (ক) ঈশ্বরের বাণীর আলোতে অতীতের বিষয় ধ্যান করে তাঁর যুগের ঘটনাবলির গভীর তাৎপর্য আবিষ্কার করেন (খ) ঈশ্বরের ইচ্ছা বুঝতে পারেন (গ) ভবিষ্যতের জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা জানতে পারেন এবং (ঘ) ঈশ্বরের নামে মানুষের কাছে এসব বিষয় নির্ভয়ে ঘোষণা করেন তিনিই প্ৰবক্তা ৷
প্রবক্তা মুখ্য বা গৌণ হতে পারেন। মুখ্য বা গৌণ প্রবক্তা বলতে কারো গুরুত্ব বেশি বা কারো গুরুত্ব কম বোঝায় না। কোনো কোনো প্রবক্তার গ্রন্থে যতখানি ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে অন্যগুলোতে তত পরিমাণে নেই। সেজন্য যাঁদের বাণীপ্রচার বেশি পরিমাণে লেখা হয়েছে তাঁদেরকে বলা হয় মুখ্য প্রবক্তা। আর লেখার মধ্যে যাঁদের কম বাণী স্থান পেয়েছে, তাঁদেরকে বলা হয় গৌণ প্রবক্তা। তবে মুখ্য বা গৌণ উভয়ের বেলায় একথা সত্য যে, তাঁদের বাণী স্বয়ং ঈশ্বরেরই বাণী এবং ঈশ্বরেরই অনুপ্রেরণায় তা লিখিত হয়েছে।
প্রবক্তা ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমেই তাঁর যাত্রা শুরু করেন। আর এই সাক্ষাতের মাধ্যমে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এবং এর ফলে ঈশ্বরের উদারতা মহানুভবতা স্বীকার করতে সক্ষম হন। এভাবে নিজেকে ও ঈশ্বরকে জানার মাধ্যমে তিনি মানুষের কাছে সহজেই ঈশ্বরকে প্রকাশ করতে পারেন ।
প্রবক্তা ঈশ্বর সম্বন্ধে যা উপলব্ধি করেন তা মানুষের কাছে সহজ ভাষায় প্রকাশ করার জন্য কখনো কখনো উপমা আবার কখনো কখনো কবিতার ভাষা ব্যবহার করেন। এসব তাঁরা ঈশ্বরের বিশেষ অনুপ্রেরণায় করতে সক্ষম হন। প্রবক্তা ঈশ্বরের বাণী ঘোষণার যে-আহ্বান পান তা ঘোষণা না করে থাকতে পারেন না। কথায় ও কাজে ভক্তজনগণ, যাজক এমনকি রাজার সামনেও নির্ভয়ে তাঁরা ঈশ্বরের বাণী শোনাতে বাধ্য। কারো মুখের দিকে না চেয়ে প্রয়োজনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ক্ষমতাশালী ও ধনীদের কাছে তাঁদের বাণী প্রচার করেন ।
পরিবেশ পরিস্থিতি যতই কঠিন, জটিল ও প্রতিকূল হোক না কেন প্রবক্তা নির্ভয়ে সত্য ও বাস্তব বিষয় মানুষের কাছে ঘোষণা করবেনই। ন্যায্যতা ও ভালোবাসার জন্য তাঁকে নিঃস্বার্থ সংগ্রাম করতে হয়। কারণ ঈশ্বর হলেন ন্যায়ের ও ভালোবাসার ঈশ্বর। তাই তিনি ঈশ্বরের হয়ে অত্যাচারিত, নিপীড়িত, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান ও তাদের পক্ষ সমর্থন করেন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম করতেই থাকেন। প্রবক্তা মানুষের ইতিহাসে ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা প্রচার করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের শক্তিতে মানুষ জগতে কল্যাণকর কিছু অর্জন করতে পারে। তাছাড়া, প্রবক্তা মানুষের মন-পরিবর্তনের অনুপ্রেরণাও দেন।
প্রবক্তা একদিকে বিভিন্ন সময় ইস্রায়েল জাতির ও বিজাতিদের মন পরিবর্তনের জন্য তাদের যত অধর্ম ও অন্যায়-অত্যাচার তুলে ধরেন ও শাস্তি ঘোষণা করেন। অন্যদিকে তিনি আবার ঘোষণা করেন মুক্তিদাতার আগমনবার্তা। তিনি সেই মুক্তিদাতার কথা বলেন যিনি তাঁর প্রিয়জনদের মনের দুঃখ দূর করে দেবেন ও চোখের জল মুছে ফেলবেন। এভাবে তিনি নিরাশ অন্তরে এনে দেবেন ঈশ্বরের পরিত্রাণের আনন্দ এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাগিয়ে তুলবেন নতুন আশার আলো।
পবিত্র বাইবেলে মোট ১৬ জন প্রবক্তার নামে গ্রন্থ আছে। তাঁদের মধ্যে চারজন হলেন মুখ্য প্রবক্তা এবং বারো জন হলেন গৌণ। চারজন মুখ্য প্রবক্তার নাম হলো : ১। ইসাইয়া (যিশাইয়) ২। জেরেমিয়া (যিরেমিয়) ৩। এজেকিয়েল (যিহিস্কেল) এবং ৪। দানিয়েল। বারো জন গৌণ প্রবক্তার নাম হলো : ১। হোসেয় ২। যোয়েল ৩। আমোস ৪। যোনা ৫। ওবাদিয়া ৬। মিখা ৭। নাহুম (নহুম) ৮। হাবাকুক (হবককুক) ৯। সেফানিয়া (সফনিয়) ১০। হগয় ১১। জাখারিয়া (সখরিয়) ১২। মালাখি।
তাঁদের ছাড়াও ইস্রায়েলের ইতিহাসের মোশী, সামুয়েল, নাথান (নাথন), এলিয় ও এলিসেয় এবং দীক্ষাগুরু যোহনের প্রবক্তাদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
বিভিন্ন প্রবক্তার মতো নাথানও একজন ঈশ্বর প্রেরিত প্রবক্তা। তিনি ঈশ্বরের নির্দেশে রাজা দাউদকে তাঁর পাপ সম্পর্কে তিরস্কার করেছেন। প্রবক্তার তিরস্কারে রাজা দাউদ মন পরিবর্তন করেছিলেন। আমরা এখন সেই অংশটুকু পাঠ করব।
একদিন হলো কি, সন্ধ্যার দিকে দাউদ বিছানা ছেড়ে উঠে রাজবাড়ির ছাদে একটু বেড়াচ্ছেন, এমন সময়ে ছাদ থেকে তাঁর চোখে পড়ল, একজন নারী স্নান করছে। নারীটি দেখতে খুবই সুন্দরী। রাজা দাউদ জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে, সে উরিয়া নামে তার একজন সৈনিকের স্ত্রী, নাম বাৎসেবা । উরিয়া তখন তার সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধেক্ষেত্রে ছিল। রাজা এ সুযোগে লোক পাঠিয়ে বাৎসেবাকে নিজের বাড়িতে আনলেন। কিছুদিন পর স্ত্রীলোকটি গর্ভবতী হলো। তখন দাউদ তার সেনাপতি যোয়াবের কাছে একটি পত্র দিলেন। তাতে লেখা ছিল তুমি উরিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সারিতে রাখ । তারপর তাকে একলা ফেলে পিছিয়ে এসো সে যেন নিহত হয়। সেনাপতি রাজার হুকুম পালন করল। বাৎসেবা যখন স্বামীর মৃত্যুর খবর পেল তখন কেঁদে ফেলল। তার শোকের সময় পার হয়ে গেলে রাজা দাউদ তাকে বিয়ে করলেন। সে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিল।
এতে ঈশ্বর দাউদের উপর অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি প্রবক্তা নাথানকে দাউদের কাছে পাঠালেন। নাথান এসে দাউদকে বললেন, “এক দেশে দুই জন লোক থাকত। তাদের একজন ছিল ধনী আর একজন গরিব। ধনী লোকটির ছিল ছোটবড় গবাদিপশুর বিরাট বিরাট পাল, কিন্তু গরিব লোকটির কিছুই ছিল না, শুধু বাচ্চা একটি ভেড়ি ছাড়া, যেটিকে সে কিনেছিল আর নিজেই পুষছিল। ভেড়িটি তার ঘরে তার নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থেকেই বেড়ে উঠছিল। সে ওই গরিব লোকটির খাবার থেকেই খেতে পেত, খেত তারই বাটির জল এবং তার কোলে শুয়েই ঘুমাত। তার কাছে সে ছিল যেন মেয়েরই মতো। একদিন হলো কি, ওই ধনী লোকটির বাড়িতে এলো একজন পথিক। এই অতিথি যাত্রীর খাবার তৈরি করবার জন্যে ধনী লোকটি কিন্তু নিজের কোনো ভেড়া বা গরু দিতে চাইল না। সে তখন গরিব লোকটির সেই ভেড়ীটিকে নিয়েই অতিথির খাবার তৈরি করল।”
ওই লোকটির উপর দাউদ তখন রেগে আগুন হয়ে নাথানকে বললেন : “ঈশ্বরের অস্তিত্বেরই দিব্যি দিয়ে বলছি আমি, ওই যে-লোকটা, যে অমন কাজ করেছে, মৃত্যুই তার যোগ্য শাস্তি। কোনো দয়া-মায়া না দেখিয়ে সে যখন অমন কাজ করেছে, তখন ক্ষতিপূরণ হিসাবে তাকে ওই ভেড়ির চারগুণ দাম দিতে হবে।” নাথান তখন দাউদকে বললেন : “কিন্তু সেই লোক তো আপনি নিজেই! তখন দাউদ নাথানকে বললেন, “সত্যিই আমি ঈশ্বরের কাছে পাপ করেছি!” উত্তরে নাথান বললেন, “বেশ, ঈশ্বর তাহলে আপনার পাপ মার্জনা করছেন তাই আপনাকে মরতে হবে না। তবে ওই কাজটা করে আপনি যখন ঈশ্বরের প্রতি নিতান্তই অবহেলা দেখিয়েছেন, তখন আপনার এই যে শিশুটি জন্মেছে, তাকে মরতেই হবে।” এরপর নাথান নিজের ঘরে ফিরে গেলেন ৷
কয়েক দিনের মধ্যে ছেলেটার ভীষণ অসুখ হলো, দাউদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রার্থনা ও উপবাস করতে লাগলেন। সাত দিনের মধ্যে ছেলেটা মারা গেল। এই শাস্তি ভোগ করার মধ্য দিয়ে দাউদ পাপমুক্ত হলেন ও মন পরিবর্তন করে ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসলেন।
বর্তমান যুগেও আমরা নিম্নলিখিত কাজগুলো করে প্রবক্তার ভূমিকা পালন করতে পারি:
১। যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী সকলের কাছে খ্রিষ্টের বাণী প্রচারের মাধ্যমে ;
২। সর্বদা সত্য কথা বলে ও সত্য পথে চলে;
৩। খ্রিষ্টবিশ্বাস অনুসারে জীবন যাপন করে খ্রিষ্টের বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে;
৪। অনৈতিক অবস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করে;
৫। বাস্তবতার আলোকে নিজের মতামত প্রকাশ করার মাধ্যমে ।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ঈশ্বরের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে ন্যায্যতা স্থাপনকারীকে প্রবক্তা বলা হয়। প্রবক্তা নাথান রাজা দাউদকে ঈশ্বরের বাণী জানাতে দ্বিধা করেন নি।
১। প্রবক্তা নাথান রাজা দাউদকে কীভাবে ঈশ্বরের বাণী শুনিয়েছেন তা ক্লাসে অভিনয় কর।
২। প্রবক্তার ভূমিকা সম্পর্কে দলে আলোচনা কর ।
ক) পবিত্র বাইবেলে ___ জন প্রবক্তার নামে গ্রন্থ আছে।
খ) ঈশ্বর হলেন ন্যায়ের ও ___ ঈশ্বর।
গ) প্রবক্তা মানুষের ইতিহাসে ঈশ্বরের ___ কথা প্রচার করেন।
ঘ) প্রবক্তা ঈশ্বরের সঙ্গে ___ মাধ্যমেই তাঁর যাত্রা শুরু করেন ।
ঙ) ঈশ্বর প্রবক্তা ___ দাউদের কাছে পাঠালেন।
ক) বাইবেলে চারজন মুখ্য প্রবক্তা এবং | ক) মন পরিবর্তন করেছিলেন। |
খ) বিভিন্ন প্রবক্তার মতো নাথানও একজন | খ) সেই লোক তো আপনি নিজেই। |
গ) প্রবক্তার তিরস্কারে রাজা দাউদ | গ) বারোজন হলেন গীণ প্রবক্তা। |
ঘ) নাথান তখন দাউদকে বললেন | ঘ) তা মানুষের কাছে সহজ ভাষায় প্রকাশ করেন। |
ঙ) প্রবক্তা ঈশ্বর সম্বন্ধে যা উপলব্ধি করেন | ঙ) অনুপ্রেরণা যোগাতে সক্ষম হন। |
চ) ঈশ্বরপ্রেরিত প্রবক্তা । |
ক। সেনাপতি কার হুকুম পালন করেছিলেন?
খ। ঈশ্বর কার উপর অসন্তুষ্ট হলেন?
গ। প্রবক্তা নাথান কিসের মাধ্যমে রাজা দাউদকে সতর্ক করেছিলেন ?
ঘ। রাজা দাউদ তাঁর অন্যায়ের জন্য কী শাস্তি পেয়েছিলেন?
ক। বারোজন গৌণ প্রবক্তার নাম লেখ ।
খ। প্রবক্তা নাথান কীভাবে রাজা দাউদকে সতর্ক করেছিলেন?